চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা শঙ্খনদী আজ মৃত হয়ে নদীর মাঝপথে চর বয়ে বিস্তীর্ণ সংকট দেখা দিচ্ছে। নদীর নাব্যতা হারিয়ে নদটি এখন অস্তিত্ব হারিয়ে সংকট হয়ে পড়েছে। শঙ্খ নদীর মাঝপথে ও উভয়পাশে চর উটজে খালে পরিণত হয়েছে নদটি।
অথচ এক সময়ে সেই শঙ্খ ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের যাতায়াত পথ অর্থাৎ অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চালক এতে নৌপথে যাতায়াত ছাড়াও পণ্য নিয়ে বড় বড় নৌকা ও লঞ্চ চলতো শঙ্খনদ দিয়ে।
বিশেষ করে পর্তুগীজ আমলে এই নদ দিয়েই মায়ানমারের বিভিন্ন শহর,ভারতের কলকাতা পর্যন্ত চলতো যাত্রী ও পণ্যবোঝাই নৌকা-জাহাজ সহ বিভিন্ন ধরনের নদীর যানবাহন। শঙ্খের মোহনায় ছিল পর্তুগীজদের দস্যু বন্দর। আশির দশকেও এই শঙ্খ দিয়ে চট্টগ্রাম নগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলতো নৌযান।
বর্তমানে ছোট ছোট অসংখ্য নৌকা ছাড়াও দুই শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার ও বোট রয়েছে। আগে সারা বছরই এমন অবস্থা থাকলেও বর্তমানে শুস্ক মৌসুমে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
এই শঙ্খ নদী বাংলাদেশ ও আরাকান রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চল আরাকানের মদক পাহাড় থেকে শঙ্খনদের উৎপত্তি। সর্পিলাকার ১৯৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদ বান্দরবান হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা-বাঁশখালীর সীমান্ত দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে নানা কারণে বিপন্ন হয়ে পড়া শঙ্খ দিন দিন আরও বেশি বিপন্নতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এতে করে শঙ্খের তীরবর্তী এলাকাগুলোতে আবাদি জমি থাকলেও পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারছেন না কৃষকরা। আর যেসব কৃষক চাষাবাদ করছেন তাদের ফলনও আশানুরূপ হচ্ছে না। এ কারণে আবাদি জমিগুলোও এখন অনাবাদি হয়ে পড়ছে। শঙ্খের শাখা-প্রশাখাগুলোও দিন দিন অস্তিত্ব সংকটে পড়ায় এ অবস্থা আরও খারাপ হবে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে আগামী কয়েক দশকে নদের তলদেশ ভরাট হয়ে পুরোপুরি নাব্যতা হারিয়ে ফেলবে।
সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,শঙ্খনদীর আনোয়ারা ও বাঁশখালী অংশের ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ১৫টি স্থানে চর দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর,বারখাইন,বরুমচড়া কানু মাঝির হাট,পঙ্খীর চর,চর জুঁইদন্ডী ও বাঁশখালী উপজেলার পশ্চিম বরুমচড়া,বৈলগাঁও এবং চমকারদিয়ার চর এলাকায় বিশাল বিশাল চর জেগেছে।
এতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও চর উঠলে শঙ্খের গতি একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে স্থানীয়দের আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। শঙ্খনদের তৈলারদ্বীপ অংশ থেকে শঙ্খের মোহনা পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন করা হলে নদটি আবারও গতিশীল হবে বলে মনে করেন তারা।
জুঁইদন্ডী গ্রামের শঙ্খপাড়ের বাসিন্দা আবদুল গফুর বলেন,১৯৯১ সালের ভয়াবহ বন্যার আগে শঙ্খনদে প্রচন্ড স্রোত ছিল এবং নদীও ছিল খুবই গভীর। বন্যার পর থেকে শঙ্খনদে চর পড়া বৃদ্ধি পায়। আর সেখানে মাছের ঘেরসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ শুরু হয়। গত পাঁচ বছরের মধ্যে অতিরিক্ত চর পড়ে নদ সরু হয়ে গেছে।দক্ষিণ বরুমচড়া-কানু মাঝির ঘাটের মাঝি খুইল্যা মিয়া জানান,১০ বছর আগেও শঙ্খের এপার থেকে ওপারে নৌকা নিয়ে যেতে হলে ¯্রােতের কারণে অনেক ভাটিতে গিয়ে নৌকা থামাতে হতো। এখন সোজা গিয়ে নদ পার হওয়া যায়। বছরের অর্ধেক সময় শঙ্খনদের পানি কম থাকে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়,পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রচুর বালু ও পলি চলে আসায় শঙ্খনদে স্তর পড়ে ভরাট হচ্ছে। এ কারণে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় শঙ্খনদে পানিপ্রবাহ কমে গেছে। নদটি নাব্যতা হারিয়ে ফেললেও এটি খননে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পাউবো চট্টগ্রাম পওর বিভাগ-১ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম দাশ বলেন,শঙ্খনদে চর পড়ায় অনেকটা নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। শুকনো মৌসুমে এমন রূপ পায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে শঙ্খনদ খননে আপাতত আমাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই।
চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন,‘নদীর সঙ্গে এ দেশের মানুষের কৃষি,জীবনযাপন,জীবিকা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক। তাই নদীবিহীন বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। শঙ্খনদ দেশের প্রধান নদীগুলোর অন্যতম। এটিকে খননের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
Leave a Reply