আলমগীর: লামায় উপজেলার সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান শারদীয় দূর্গোৎসবের প্রস্তুতি শেষের পথে। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে প্রতিমায় কারুকার্যও শেষ।ব্যাপক ডামাঢোলের মধ্য দিয়ে উপজেলার ৮টি মন্দিরে চলছে সাজসজ্জা।বড়দের পাশাপাশি শিশুরা এ আয়োজনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।লামা কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরের শ্রীযুক্ত বিজয় কান্তি আইচ বলেন,অন্যরকম এক আনন্দ দূগোৎসবকে ঘিরে।লামা উপজেলার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রতিমা তৈরি হয়েছে লামা কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরে। মাসাধিকাল থেকে একদল গুণী শিল্পী প্রতিমা তৈরি শেষ করেছেন।
এদিকে উপজেলার ৮টি পূজা মণ্ডপে আনন্দমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপনে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকেও নেয়া হয়েছে সব ধরনের প্রস্তুতি।কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরের পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্রীযুক্ত বাবুল কান্তি দাশ জানান,লামা উপজেলায় সবসময়ই সব ধর্মের লোকজনের সহযোগীতায় অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপিত হয়ে আসছে।স্থানীয় লোকজনের আন্তরিকতা সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে শারদীয় দূর্গোৎসবসহ সব ধরনের ধর্মীয় উৎসব পালনে থানা ও উপজেলা প্রশাসনের আন্তরিকতা লক্ষনীয়।
লামা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, আমরা শতভাগ আশাবাদি কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।পুলিশের পাশাপাশি আনসার-ভিডিপি সদস্য ও পূজা মন্ডপ গুলোতে পূজা চলাকালীন সময়ে অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।লামা হরি মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি বাবু প্রশান্ত ভট্টাচার্য্য বলেন, দেবীবোধন দিয়ে শুরু দুর্গোৎসব।দেবী দুর্গা শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যা রূপে মর্ত্যলোকে আসছেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। সঙ্গে আসছেন জ্ঞানের প্রতীক দেবী সরস্বতী;ধন,ঐশ্বর্যের প্রতীক দেবী লক্ষ্মী,সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বলবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক কার্তিক।এঁরা মায়ের চার সন্তান।দেবী মেনকার তাই ফুরসত ফেলার সময় নেই।
বছর বাদে মেয়ে আসছেন বাপের বাড়ি,মেয়েকে বরণ করতে তাই তাঁর এত আয়োজন।ওদিকে দেবী দুর্গাকে বরণ করতে ভক্তরাও সমানভাবে উদগ্রীব।তাদের আয়োজনও কম নয়। ঘরের বউ-ঝিরা কেউ খই-গুড়ে পাক দিচ্ছেন,কেউ বানাচ্ছেন নারিকেলের নাড়ু,মুড়ির মোয়া।স্কুল বন্ধ।পূজার ছুটি।নতুন জামা-কাপড়।ছোটদের আনন্দ আরো বেশি।ওদিকে পালমশায় ব্যস্ত প্রতিমা গড়া নিয়ে।মায়ের চোখে সন্তানের জন্য স্নেহ,মুখে মমতাময়ী হাসি এসব ফুটিয়ে তোলা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।পুরোহিত ব্যস্ত পূজার আয়োজন নিয়ে। মেনকার মতো সব দিকেই তাঁর দৃষ্টি।কারণ তিনি যে দুর্গতিনাশিনী,জগজ্জননী।
দশমীর মাধ্যমে দেবী পিতৃগৃহ থেকে কৈলাসে ফিরে যাবেন স্বামী শিবের কাছে। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই সত্যকে অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে শারদীয় দুর্গোৎসব।কবি কৃত্তিবাস পনেরো শতকের মাঝামাঝি তদানীন্তন গৌরেশ্বর রাজা গণেশের অনুরোধে বাংলা-রামায়ণ রচনা করেন।সেখানে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ রয়েছে।পিতা দশরথের কথা রক্ষায় শ্রীরামচন্দ্র স্ত্রী সীতা এবং অনুগত ছোট ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসের উদ্দেশে পঞ্চবটী বনে এলে রাবণ সীতাকে হরণ করে অশোক বনে আটকে রাখে।শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং অবতার হয়েও রাবণকে বধ করে সীতা উদ্ধারে দেবী দুর্গার পূজা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব আয়োজন সম্পন্ন করে পূজা করতে বসে রামচন্দ্র অঞ্জলি দেওয়ার সময় ১০৮টি নীলপদ্মের জায়গায় ১০৭টি নীলপদ্ম পান।অথচ ওই একটি নীলপদ্ম না হলে যে পূজা সম্পূর্ণ হবে না!এখন উপায়?তখন রামচন্দ্র ধনুর্বাণ দিয়ে নিজের চোখ উৎপাটনে উদ্যত হন।যাতে হারিয়ে যাওয়া সেই একটি নীলপদ্মের বদলে চোখ দিয়ে মায়ের পূজায় অঞ্জলি দেওয়া যায়। কারণ রামের আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন।রামচন্দ্রের ভক্তি দেখে দেবী দুর্গা অভিভূত হন।তিনি তখন সহাস্যে স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে রামচন্দ্রকে চোখ উৎপাটনে বাধা দিয়ে সেই নীলপদ্মটি ফিরিয়ে দেন।কেননা ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করতে ওই নীলপদ্মটি ছলনা করে মা নিজেই লুকিয়ে রেখেছিলেন।
দেবী দুর্গার আশীর্বাদে রামচন্দ্র পরবর্তী সময়ে রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন।এর পর থেকেই শরৎকালে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে।আদিতে বসন্তকালেই দুর্গাপূজা হতো।পুরাণ অনুসারে সত্য যুগে রাজা সুরথ রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে আশ্রয় নেন।এই মহাসংকট থেকে উদ্ধার পেতে সত্যদ্রষ্টা মেধস মুনি রাজা সুরথকে দুর্গাপূজার পরামর্শ দেন।তখন তিনি ভক্তি সহকারে দুর্গাপূজার উদ্যোগ নেন। এ পূজা বসন্তে হয় বলে একে বাসন্তী পূজা বলা হয়।পূজা যে সময়ই হোক না কেন উদ্দেশ্য কিন্তু এক।সনাতন ধর্মের প্রাচীন আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের প্রতীক হিসেবে দেবী দুর্গার প্রসন্নতা ও আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন।এ যুগেও সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তরা হৃদয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে আনন্দময়ী দুর্গার অর্চনা করেন। কারণ তিনি সর্বশক্তির আধার।
মাতৃরূপে তিনি সর্বজীবে বিরাজ করে জীবের দুর্গতি নাশ করেন বলেই তাঁর নাম দুর্গা। শত্রু নাশে এ কারণেই তাঁর ১০ হাতে ৯ অথবা ১০ রকম অস্ত্র শোভা পায়।ডান হাতে ত্রিশূল, খৰ ও চক্র।বাম হাতে শঙ্খ, ঢাল,কুঠার, ঘণ্টা। এর প্রতীকী তাৎপর্য আছে বৈকি! সত্য প্রতিষ্ঠা,ভক্তের দুর্দশা লাঘবে শত্রুকে তিনি ছাড় দিতে রাজি নন।সব শক্তি একত্রিত করে তিনি সমূলে শত্রু নাশ করতে চান।দুর্গাপূজা এক অর্থে তাই মহাশক্তির প্রতীকী রূপও বটে।পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচারী,পাপিষ্ঠদের রুখে দিয়ে শোষকের হাত থেকে শোষিতদের উদ্ধার করতে,সত্যকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠা করতে আজ এই মহাশক্তির আরাধনা বড় বেশি প্রয়োজন।বিজয়া দশমী শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিন।প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতার।এদিন সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হবে।এবার দোলায় এসেছেন মা দুর্গা, আবার যাবেনও ঘোটকে।
Leave a Reply