
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
গণপূর্ত অধিদপ্তর — দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখানে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রতিবছর বরাদ্দ হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ এই বিপুল অর্থের প্রবাহের ভেতরে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য “ক্ষমতার সাম্রাজ্য”। গত এক দশকে রাজধানীকেন্দ্রিক একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট নীরবে নিয়ন্ত্রণ করছে টেন্ডার, বদলি এবং কমিশন বাণিজ্যের পুরো কাঠামো। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকার গণপূর্ত বিভাগের এক্সেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আতিকুল ইসলাম, যাকে সবাই আতিক নামে চেনে। তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও দক্ষ, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে গড়ে ওঠে প্রভাবশালী ঠিকাদার, রাজনৈতিক ছত্রছায়া আর প্রশাসনিক দালালদের এক জটিল নেটওয়ার্ক। ২০০৮ সালে ২৭তম বিসিএস ব্যাচ থেকে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া এই প্রকৌশলী কয়েক বছরেই রাজধানীর বিভিন্ন বড় টেন্ডার, বদলি বাণিজ্য ও কমিশন নেটওয়ার্কে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছেন। সরকারি কাজের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজের ক্ষমতার একটা বিস্তৃত জাল তৈরি করেছেন। আতিকুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার যাদুপুর শিমুলতলায় ১৯৮১ সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা-মাতা দুজনেই সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। আতিক রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে এসএসসি, রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে এইচএসসি শেষ করেন এবং ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৮ সালে গণপূর্তে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি ২০১০ সালে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এবং ২০১৭ সালে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে উন্নীত হন। তার স্ত্রী কানিজা মুস্তারিনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেছেন এবং বর্তমানে ঢাকা সিটি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ঢাকার বিভিন্ন গণপূর্ত বিভাগে তার দীর্ঘ সময়ের পোস্টিং তাকে শক্তিশালী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করেছে। ২০১১/১২ সাল থেকে ঢাকায় অবস্থানকারী আতিক প্রায় ৫ বছর শেরে বাংলা নগর গণপূর্তে এসডিই হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে ৪–৫ মাস সাময়িকভাবে নড়াইল জেলার দায়িত্ব পালন শেষে তিনি সেগুনবাগিচার রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তার সহযোগিতা পেয়েছিলেন তারিক সিদ্দীকি। আতিকের বিশ্বস্ততা এবং সখ্যতার কারণে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এক্সেন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করার কারণে আতিকুল ইসলাম গণপূর্তে এক প্রভাবশালী ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। আতিকুল ইসলামের রাজনৈতিক সংযোগও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারিক সিদ্দীকির সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিলো তার। বিশেষ করে হাসিনা ও শেখ রেহানার ব্যক্তিগত বাড়ি মেইন্টেইন করার দায়িত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে আতিকুল ইসলামের নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুলশান-২ এর ৮৪ নম্বর রোডের ১০ নং বাড়ি, যা শেখ রেহানার, গণপূর্ত রক্ষনাবেক্ষণ বিভাগের আওতায় ছিল। এখানে এক্সেন ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহ আলম ফারুক চৌধুরী। ২০১৮ সালে গণভবন, ধানমন্ডি ৩২ এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নতুন এক্সেন নিয়োগের সময় ফারুক ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বস্ত হিসেবে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফারুককে অন্য দায়িত্বে নিয়ে গেলে, রেহানার বাড়ির জন্য বিশ্বস্ত ছাত্রলীগ নেতা প্রয়োজন হয়, যার জন্য আতিকুল ইসলামকে পদায়ন করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে প্রায় ৫ বছর তিনি গণপূর্ত রক্ষনাবেক্ষণ বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২ জুলাই ২০২২ এ মোস্তাফিজ সবুজের সাথে স্থান পরিবর্তন করে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ ১-এ দায়িত্বে আসেন। জুলাই ২০২৪ এ তিনি শেরেবাংলা নগর ৩-এ স্থানান্তরিত হন। এই কৌশলগত অবস্থান এবং রাজনৈতিক সংযোগের কারণে আতিকুল ইসলাম রাজধানীর গণপূর্তে শক্তিশালী প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তার প্রশাসনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং দীর্ঘমেয়াদি পোস্টিং তাকে সিন্ডিকেটের অদৃশ্য শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঢাকা নগরে দীর্ঘকাল বিভিন্ন গণপূর্ত বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করা আতিক তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেটওয়ার্ককে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে, রাজধানীর কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী পদে বদলি করতে চাইলে তার অনুমোদন বা টাকা ছাড়াই আদেশ প্রায় সম্ভব নয়। জানা যায়, সচিব বা উপদেষ্টার সুপারিশ থাকলেও, বদলির কার্যক্রমে আতিকের প্রভাব অগ্রণী। এই প্রভাবশালী অবস্থান ব্যবহার করে তিনি গত ৮–৯ মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। ২০১৭ সালের শেষদিকে, নড়াইল থেকে সেগুনবাগিচায় গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে দায়িত্ব নেওয়ার পর আতিকের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যাত্রা দ্রুত এগিয়ে যায়। বিশেষ করে ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত যখন তিনি গুলশান-২, ৮৪ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ি (শেখ রেহানার সরকারি বাসভবন) তত্ত্বাবধান করতেন, তখন থেকেই তারিক সিদ্দিকী ও শেখ রেহানার আস্থাভাজন হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। এই সময়কালকে কেন্দ্র করে গণপূর্ত থেকে সংগৃহীত কমিশনের অর্থ প্রথমে জিকে শামীমের মাধ্যমে, পরে নুসরাত হোসেনের হাত ঘুরে আতিকের মাধ্যমে শেখ রেহানার বাসায় পৌঁছাত। এর ফলে গণপূর্ত মহলে আতিককে ডাকা হতো “শেখ রেহানার ক্যাশিয়ার” বলে। ২০২২ সালে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ–১ এবং ২০২৪ সালে শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ–৩-এ পদায়ন হয়ে তার ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। রাজধানীতে দীর্ঘসময় অবস্থানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে আতিক এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন যা এখন বদলির সিদ্ধান্তে প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। গণপূর্তের কর্মকর্তা আতিকুল ইসলাম, বা আতিক, দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি প্রকল্পে প্রভাব খাটিয়ে আসছেন। তার স্ত্রী কানিজা মুস্তারিনা ও বন্ধু জাহিদুর রহমান ২০০৮ সালে “Adroit Consultants & Engineers” নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন। পরে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠান এককভাবে জাহিদ ও কানিজার মালিকানায় আসে।
Leave a Reply