রিপন শান
বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে বিশ্বপ্রেমের নবতর বারতা নিয়ে মঞ্চায়িত হলো জীবন-মনস্তাত্ত্বিক গবেষণাধর্মী নাটক "জালাল উদ্দিন রুমী" । বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে ৮ নভেম্বর ২০২৫ ভরপুর দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিতে মঞ্চস্থ হয়েছে "জালাল উদ্দিন রুমী" । বাংলাদেশ পারফরম্যান্স আর্ট গ্রুপের থিয়েটার পারফরমেন্সটি রচনা করেছেন অপূর্ব কুমার কুন্ডু এবং নির্মাণ ও উপস্থাপনা করেছেন তারুণ্যদীপ্ত দৃশ্যশিল্পী সুজন মাহাবুব। গবেষনাগার প্রযোজনাধর্মী এই পারফরম্যান্সের কাহিনী গড়ে উঠেছে জালালউদ্দিন রুমীর অন্তিম প্রয়াণের শেষ এক ঘন্টাকে ঘিরে। সূর্য ডুবার পর মাগরীবের নামাজের আযানের মধ্যে দিয়ে নাটক শুরু এবং আলোকিত চাঁদের জ্যোৎস্না ফোঁটার মধ্য দিয়ে নাটকের সমাপ্তি। কেনিয়া রাজ্যের এবং রুম প্রদেশের শাসনকর্তা মঈন উদ্দীন শাহ পরওয়ানের একান্ত অনুরোধে জালালউদ্দীন রুমী'র মৃত্যু পরবর্তী সমাধিস্থান নির্মাণ ভাবনা এবং শোকগাঁথা তথা এপিটাফ রচনার প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই নাটকটি। জালালউদ্দীন রুমীর অন্তিম ভাবনা চিন্তা এবং শোকগাঁথা রচনার অন্তিম মুহূর্তগুলিতে স্মৃতি হয়ে একে একে ধরা দেয় মঈন উদ্দীন শাহ পরওয়ানের আগমন ও আবেদনের কথা, জন্ম দাত্রী মাতা মুইমিনা খাতুনের স্নেহ-আদরে পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন আত্মস্থ করার কথা, গওহর খাতুনের মতো জীবনসঙ্গীর সংস্পর্শে দিওয়ানে শামস তাব্রিজী রচনার কথা, অসংখ্য গুণগ্রাহীর পার্থিব ও আধ্যাত্মিক প্রশ্নের উত্তর এবং সংশয়ের সমাধান দেওয়ার কথা, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় শিক্ষাগুরু শামস তাব্রিজীর সান্নিধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করার কথা, চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের আক্রমনের হাত থেকে সমৃদ্ধ নগরী দামেস্কাসকে রক্ষা করা সহ আরও অনেক ঘটনার ঘনঘটা। ঘটনার ঘনঘটার ঘূর্ণন আবর্তে সমাধিস্থান নির্মাণ ভাবনা রচনার পাশাপাশি শেষাবধি এফিটাফ তথা শোকগাঁথা রচিত হয়।আর-সেখানেই নাটক-জালালউদ্দীন রুমী, যেন মহাকবি- মাওলানা-দার্শনিক জালালউদ্দীন রুমী'র চিরন্তন অস্তিত্বের সন্ধান খুঁজে পাওয়া যায় তারই রচিত এপিটাফ তথা শোকগাঁথা রচনা নামায়, "যখন আমি আর স্বশরীরে নাই/ তখনও আছি আমি প্রেম বিরহে মানবের হৃদয়।" নাট্যকার অপূর্ব কুমার কুন্ডু বলেন, মহাকবি রুদাকী, মহাকবি ফেরদৌসি, মহাকবি শেখ সাদী পারস্য কাব্য সাহিত্যোকাশে এক একটি স্বর্ণোর্জ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী জালালউদ্দিন রুমী। আপন আলোয়, আপন শক্তিতে উদ্ভাসিত রুমীকে ইতিহাসের আলোয় দেখার নাটক জালালউদ্দিন রুমী। তিনি পারস্যের, তিনি পাশ্চাত্যের আবার তিনিই আমাদের এই প্রাচ্যের। তিনি কবি, তিনি মহাকবি, তিনি বিশ্বের কবি জালালউদ্দিন রুমী। এ নাটক তাঁর বর্ণিল জীবন এবং তাঁর সৃজিত সাহিত্য কর্মকে আশ্রয় করে। আশ্রয়ের এই যাত্রাপথে নাট্যকারের সীমিত সঞ্চয় বলতে, ইরানী চলচ্চিত্র গবেষণা গ্রন্থ এবং শেখ সাদী নাটক রচনার অভিজ্ঞতা এবং উপলব্দি। এবারের রচনার ক্ষেত্রে প্রধানতম সহায়ক জালালউদ্দীন রুমিকে নিয়ে রচিত অসংখ্য গ্রন্থ এবং জালালউদ্দীন রুমী রচিত গ্রন্থের অনুবাদ। নাট্যকার গভীরভাবে কৃতজ্ঞ মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ রচিত পারস্য প্রতিভা, মুস্তফা জামান আব্বাসী রচিত রুমির আলৌকিক বাগান, অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন রচিত ইরানের কবিসহ অসংখ্য লেখক এবং তাঁদের রচিত গ্রন্থের প্রতি। জালালউদ্দীন রুমী রচিত মাসনবী এবং দিওয়ানে শামসে তাব্রিজি'র অনুবাদকের প্রতি একইভাবে কৃতজ্ঞ নাট্যকার। থিয়েটার পারফরমেন্স নির্মাতা ও উপস্থাপক দৃশ্যশিল্পী সুজন মাহাবুব বলেন, বাংলাদেশ পারফরম্যান্স আর্ট গ্রুপের থিয়েটার পারফরম্যান্স – জালালুদ্দিন রুমি সমকালীন শিল্পের এক অনন্য রূপ। যেখানে পটচিত্র, যাত্রা, বাচিক নাট্য, শ্যাডো থিয়েটার, কবিতা, সুরের আলো ও শরীরের অভিব্যক্তি ব্যবহার একত্র হয়ে সৃজনশীল মঞ্চে সৃষ্টি করছে এক শৈল্পিক প্রকাশভঙ্গি। এ পারফরম্যান্স শুধু বিনোদন নয়, বরং দর্শকের হৃদয়ে আধুনিকতার ভেতরে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক সুরের চিন্তা এবং অনুভূতির নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস । সত্য, সুন্দর আর কল্যাণ শান্তির পথে জীবন করবো দান... থিয়েটার পারফরম্যান্স নির্মাণের বিভিন্ন পর্বে রয়েছেন মঞ্চসজ্জায় ফজলে রাব্বি সুকর্ণ, আবহ সংগীতে হামিদুর রহমান পাপ্পু, আলোকসজ্জায় মো. বজলুর রহমান,অঙ্গরচনায় শুভাশীষ দত্ত তন্ময়, পোষাক সজ্জায় আমেনা বেগম,কোরিওগ্রাফার রুহী আফসানা দীপ্তি, শব্দ প্রয়োগ মুগ্ধ আনন, শব্দ প্রকৌশলী মো. হোসেন,শব্দ প্রকৌশলী সহযোগি হাবিবুর রহমান আওলাদ, অর্কেস্ট্রায় শামসুল ইসলাম খা, জিনিয়া জেবা, চঞ্চল, আনন্দ, নারায়ন দাস লিটন এবং প্রযোজনা অধিকর্তা আবুল কাশেম মাতাব্বর। পরিবেশনায়- বাংলাদেশ পারফরম্যান্স আর্ট গ্রুপ। জয়তু বিশ্বপ্রেম । জয়তু মানবপ্রেম