অনুসন্ধান প্রতিবেদন – ২
মাদক যেন থামছে না ॥ ধ্বংস হচ্ছে তরুণ ও যুব সমাজ
আওরঙ্গজেব কামাল : প্রতিটি নেশাকর দ্রব্যই অবৈধ । দেশে মাদক যেন কোন ক্রমেই থামছে না। এই মরণ নেশায় আশক্ত হয়ে যুব সমাজ বিপথ গামী হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে তরুণ ও যুব সমাজ। আমাদের দেশে প্রচলিত মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা, গাজা, ফেনসিডিল, মদ, আফিম, হেরোইন, কোকেন, প্যাথেডিন, বিভিন্ন ধরনের ঘুমের ওষুধ, এমনকি জুতার আঠাও রয়েছে। বর্তমানে আইস, এলএসডিসহ নতুন কিছু মাদকের প্রচলন দেখা যায়। মাদকবিরোধী অভিযান ও মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পরও মাদক পাচার থামছে না। বরং মাদক পাচারে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। অনেক সময় পাচারকারীদের নিত্যনতুন ও ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল দেখে হতবাক হয়ে পড়েন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও। এছাড়াও নতুন মাদক হিসেবে যোগ হয়েছে এলএসডি, ব্রাউনি বা গাঁজার কেক, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, এমডিএমএ, খাট, ব্যথানাশক ট্যাবলেট ট্যাপেন্ডাডল, স্ক্যাফ সিরাপ ও এমফিটামিন পাউডার ককটেল বা ‘ঝাক্কি। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, মাদকদ্রব্যের মধ্যে বিশেষ করে হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবা এগুলোর বেশির ভাগই সীমান্তবর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন পন্থায় রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এসব মাদক বিভিন্ন অভিযানে আটক হচ্ছে। তখন দেখা যাচ্ছে, পাচারকারীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এসব ভয়ানক নেশা জাতীয় দ্রব্য যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও মাদকের ছড়াছড়ি বেশী যা বর্তমান দেশের যুব সমাজ ধ্বংশ করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ভাবে মাদক আশক্তর সংখ্যা বাড়ছে, হয়তো অচিরে এ ভয়াভয়তা আর নিয়ন্ত্রে থাকবে না। অনন্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক বেশী। মাদক আমাদের দেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মাদকজনিত সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে, যার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে প্রশাসনের যোগসাজে মাদক দ্রব্যের ব্যাপক ভাবে এদেশে ঢুকে পড়ে এমন অভিযোগ রয়েছে। গত ৫ আগষ্ট ছাত্র – জনতার গণঅভ্যুত্যানে শেখ হাসিনা পালানোর পর কিছু দিনের জন্য মাদকের ছড়াছড়ি একটু কম থাকলেও বর্তমানে পূর্বের ন্যায় সমাজের পাড়া মহল্লায় ঢুকে পড়ছে। মাদক যুবসমাজের জন্য অভিশাপ। প্রতিনিয়ত মাদকাসক্ত হচ্ছে আমাদের যুবসমাজ। মাদক পরিবারে বয়ে আনছে অশান্তি। সমাজে আনছে বিশৃঙ্খলা। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি ও পরিবার। সর্বোপরি জাতিকে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বেকারত্ব, হতাশা, অবৈধ কাজ তথা নানাবিধ সংকটের দোহাই দিয়ে মাদক গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠছে যুবসমাজ। কারো কারো ক্ষেত্রে অনেকটা আবার কৌতুহলের ফসলও বটে। আকাশ মিডিয়ার ভয়ংকর আক্রমণের অনুকরণেও দিন দিন মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি মাদকের সহজলভ্যতা ও অবাধ বিপণনও কম দায়ি নয়। আর এটিকে ব্যাবসা হিসাবে বেছে নিয়েছে ক্ষমতা ধর অর্থশালী অসাধু ব্যবসায়ীরা। দেশে মাদকের সহজলভ্যতা ও অবাধ বিপনণের ফলেই মাদকের অপব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রবেশ করছে ভয়াবহ মাদক ইয়াবা,বাবা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, আফিম, পেথেডিন, কোকেন, মদ ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরণের অবৈধ মাদক দ্রব্য। তাহলে এখন প্রশ্ন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিরা কি নাকে তৈল দিয়ে ঘুমাচ্ছে, না তারাও এই ব্যাবসায় দু পাইচ পেয়ে মাদক ঢুকতে সহযোগীতা করছে? এ প্রশ্ন আমার নয় দেশের সর্বজনসাধারনের। প্রশাসনিক নজরদারী কম হওয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশ মাদক চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া এছাড়া মবিলের ভেতর, প্রাইভেট কার, সিএনজির অটোরিকশার ভেতরে, বাসা পরিবর্তনের কথা বলে বালিশের ভেতর ইয়াবা ও হেরোইন পাচারের মতো কর্মকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়েছে। তাছাড়া অভিনব কায়দায় অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী সেজে, গুঁড়া হলুদ ও মরিচের প্যাকেটের ভেতর হেরোইন ঢুকিয়ে পাচার করা হচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এসব বিষয় উঠে আসে। আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীরা দেশটিকে মাদক চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি মাদক দ্রব্যের বড় বাজারে পরিণত করেছে, ফলে আমাদের দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ মাদকের ভয়াল আগ্রাসনে মাদকের নিষ্ঠুর মরণ ছোবলে আমাদের সমাজের শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সচেতন-অসচেতন, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে এক ভয়াবহ ধ্বংস ও বিপর্যয়ের দ্বার প্রান্তেউপনীত করেছে । মাদকের এই মরণ ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ-যুবকের উজ্জল ভবিষ্যৎ। অনেককেই বরণ করতে হচ্ছে মৃত্যুর মত নির্মম পরিনতি । মাদকের ভয়াল গ্রাসে আজ আমাদের পরিবার ও সমাজ মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যতই দিন যাচ্ছে ততই মাদকের এই ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।পরিবারের মধ্যে বেড়েছে অশান্তি,বাড়ছে চুরি ছিনতাইসহ নানা বিধ অপরাধ। মাদক জনিত সমস্যা সমাধানের আমাদের দেশের তেমন অগ্রগতি, উন্নতি , পারিবারিক ও সামাজিক সুষ্ঠ সুন্দর পরিবেশের নেই। ফ্যামিলি হেল্থ ইন্টারন্যাশনালের সূত্রমতে, দেশের ৫২ টি পয়েন্টে প্রতিদিন বিক্রি হয় ভয়াবহ মাদক হেরোইন, ফেন্সিডিল, আফিম, পেথেডিন, কোকেন, মদ ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরণের অবৈধ মাদকদ্রব্য। এছাড়া শুধু ভারত থেকেই প্রতিদিন আসছে প্রায় ১০ লক্ষ বোতল ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য। মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন প্রবেশ করছে লক্ষ লক্ষ পিস ইয়াবা। একাধিক সুত্র জানায়, প্রাসনের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সীমান্ত দিয়ে আসা মাদক দ্রব্যের ১০ শতাংশ সীমান্তরক্ষী ও দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছে, আর বাকী ৯০ শতাংশই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। আর এসব মাদকদ্রব্য সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গড়ে ওঠেছে বড় বড় মাদক সিন্ডিকেট। এসব মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন দেশের রাজনৈতিক দলের কিছু গডফাদার ও একশ্রেণীর বিত্তশালীরা, ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে ও প্রশাসনের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন দিব্যি। ক্ষমতাসীনরা পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত সাড়ে ৩ লাখ, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের গডফাদার, সমাজের বিত্তশালী ও নারী-শিশুরা সরাসরি জড়িত বলে জানা যায় । মাদক ব্যবসার সাথে দেশের তরুণ ও যুবসমাজের একটি অংশ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণী ও হতদরিদ্র সমাজের কিছু নারী-শিশুরা জড়িত বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। মাদক ব্যবসাটি অনেক লাভজনক হওয়ায় মাদক ব্যবসাতে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। ফলে একদিকে যেমন দেশে মাদক ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মাদকের এই সহজলভ্যতার ফলে মাদক সেবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাপক হারে। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬৮ লাখ, এদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ আর ১৬ ভাগ নারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৪৭ লাখ, এদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ কিশোর, তরুণ ও যুবক। অপর আরেকটি সংস্থার জরিপ বলছে, দেশের মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও উপরে (যদিও দেশে প্রকৃত মাদকাসক্তের সংখ্যা কত তা নিয়ে বিতর্ক আছে)। তবে আমাদের জন্য উদ্ভেগের বিষয় হলো, যে হারে দেশে মাদকের অপব্যবহার বাড়ছে তাতে আগামী ৫ বছরে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ১ কোটিতে পৌছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণী। বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও দেশে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং মাদক চোরাচালানকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এনজিও, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম বা অন্যান্য ধর্মের বিশিষ্টজন, পিতামাতা, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে থেকে তাঁরা তাঁদের বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে জনগণকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা। স্কুল- কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে শিক্ষাদান ও বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে।
Leave a Reply