আওরঙ্গজেব কামালঃ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো আইনের শাসন, মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা, স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সহনশীলতা। কিন্তু
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ভিত্তিগুলোর একটির পর একটি ভেঙে পড়ছে। রাজনৈতিক খামখেয়ালিপনা, ক্ষমতা কেন্দ্রিক প্রতিহিংসা এবং দায়িত্বহীন আচরণ গণতন্ত্রকে ক্রমেই সংকুচিত করে তুলছে। বর্তমানে রাজনৈতিক
দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু যে ন্যূনতম পারস্পরিক
শ্রদ্ধাবোধ ও সংলাপের পরিবেশ থাকা উচিত—তা প্রায় অনুপস্থিত। সরকারে থাকা পক্ষ নিজেদের বিরোধী কণ্ঠে উপস্থাপন করছে, আবার বিরোধী দলগুলোও সরকারের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান নিচ্ছে। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের
বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বক্তব্যে
দ্বন্দ্ব প্রকাশ পাচ্ছে, যা জনমানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।বর্তমান
পরিস্থিতিতে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। একদিকে সরকার বলছে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ করছে না, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ অভিযোগ করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণে ব্যবহৃত হচ্ছে। একইসাথে,বিরোধী রাজনৈতিক দল ও কিছু নাগরিক আন্দোলন কখনো কখনো এমন সব কর্মসূচি ঘোষণা করছে, যা জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলছে।এর প্রভাব পড়ছে জনগণের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর। দলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্নকরণ এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক জনগণের আস্থাকে মারাত্মকভাবে নড়বড়ে করে তুলেছে। বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটারবিহীন কেন্দ্র, বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল, আগাম ব্যালট পূরণের অভিযোগ ইত্যাদি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা
কমিয়ে দিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি এক
বক্তব্যে বলেন,স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বারবার স্বৈরশাসনের আঘাত
এসেছে, রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করা হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। তার মতে, বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতিতে নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। গোলাম
পরওয়ার দাবি করেছেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চাওয়া হলেও একটি প্রধান
দলের বাধার কারণে তা বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার এবং সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। “সৈরাচারমুক্ত সুবিদাবাদ বিরোধী এক্সপ্রেস” নামের একটি ফেসবুক পেজসহ কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সাংবাদিকদের হয়রানি ও
অপমান করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাংবাদিকদের রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা সাংবাদিকতার পেশাগত নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ফলে গণমাধ্যমকর্মীরা এখন এক ধরনের ভয়ের মধ্যে কাজ করছেন। বিভিন্ন পুরাতন সাংবাদিক-বিরোধী আইন কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে—গণতন্ত্র কি কেবল নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি তা হবে একটি জীবনচর্চা, যেখানে মানুষের মতামত, অধিকার ও অংশগ্রহণ
থাকবে সম্মানের সঙ্গে?বাংলাদেশের জনগণ এমন একটি গণতন্ত্র চায়—যেখানে তারা ভয় ছাড়াই কথা বলতে পারবে, ভোট দিতে পারবে, এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতের পার্থক্য থাকলেও, সংলাপ ও সহনশীলতার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। একে অপরকে শত্রু নয়,
প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রথম শর্ত। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনৈতিক খামখেয়ালিপনার অবসান জরুরি। দলীয় স্বার্থের
ঊর্ধ্বে উঠে সংবিধান, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের অধিকার রক্ষায় একযোগে কাজ করাই এখন সময়ের দাবি। নয়তো, গণতন্ত্রের নামে একটি প্রহসনই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ।
লেখক ও গবেষকঃ
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি
ঢাকা প্রেস ক্লাব
Leave a Reply