
আওরঙ্গজেব কামাল :
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন সময়ে সাংবাদিকদের ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল সরকারের সহযোগী—স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে তথ্য সংগ্রহ ও জনমত তৈরির মাধ্যমে সহায়তা করা। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। সাংবাদিকদের ওপর ভয়, হামলা, হয়রানি, ভুয়া মামলা এবং দমন–পীড়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাদের পেশাগত স্বাধীনতা গভীর সংকটে পড়েছে। দেমে জুলাই ২০২৪–পরবর্তী দমন–পীড়নের অন্ধকার বাস্তবতা প্রতিনিয়ত চলেছে।
এ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। জুলাই ২০২৪–এর গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ওপর যে প্রবল দমন–পীড়ন নেমে এসেছে, তা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। সত্য, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতীক সাংবাদিকরা আজ রাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হুমকি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। ভুয়া মামলা, গ্রেপ্তার, হামলা, হুমকি—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ। মানবাধিকার সংস্থা আসক (ASK) জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে ২১৮ জন সাংবাদিক হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন; শুধু সংবাদ প্রকাশের কারণে মামলা হয়েছে ৩১ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে, আর ১১ সাংবাদিক পেয়েছেন হত্যার হুমকি। টিআইবির তথ্যানুযায়ী, অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে ৪৯৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার, যাদের মধ্যে ২৬৬ জনকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে গত এক বছরে তিনজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
এসব তথ্য স্বাধীন সাংবাদিকতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমরা কেন এখনো বৈশম্যের শিকার হবো। কেন এখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারে আমরা হয়রানি হচ্ছি। একজন নিরপরাধ সাংবাদিক অহেতুক নানাবিধ মামলায় ফাঁসীয়ে দিচ্ছেন। অনেক ঘটনা পর্যলচনা করে দেখি সাংবাদিদের বিরুদ্ধের অধিকাংশ মামলা হয়রানীমুলক বা স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। মিরপুর থানার ঘটনাটি দমন–পীড়নের সবচেয়ে নির্মম দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে এসেছে। অপরাধ বিষয়ক সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এশিয়ান টেলিভিশনের রিপোর্টার শিহাবউদ্দীনকে থানায় ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পরিচয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। তাঁর পরিবার জানায়—শিহাবউদ্দীন কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না; তিনি শুধু একজন পেশাদার সাংবাদিক। শুধু তিনি নন—তাঁর ভাই মোঃ নিজামউদ্দীনকেও নিজ পোশাক কারখানা থেকে ধরে নিয়ে আরেকটি মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। পরে তার কারখানা থেকে মালামাল লুট করার চেষ্টা করা হয়। অথচ অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে পিতার অসহায় আর্তনাদ—“আমরা কোনো রাজনৈতিক দলে নেই, তবু আমার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে”—রাষ্ট্রে আইনের শাসনের অবস্থানকে কঠোরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমি সরকারি অনুমতি নিয়ে সাংবাদিক শিহাব ও নিজাম এর সাক্ষাৎ করার সময় শিহাবের দুই বছরের শিশুর বাবা বাবা ডাক। শিহাব কে তার সন্তান ডেকে ডেকে কান্নায় ভেঙে পড়ার দৃশ্য শুধু এক পরিবারের নয়, পুরো সাংবাদিক সমাজের বেদনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এমন নতুন দেশ চাইনা। যেখানে আমাদের নিরাপত্তা নেই। প্রতিনিয়ত রাস্তায় পাওয়া যায় লাশ।
দখল বাজী ,চাঁদাবাজী এখনো বন্ধ হয়নি। এখনো পুলিশের ঘুস বানিজ্য বন্ধ হয়নি । অবাধে অপরাধ মুলক কর্মকান্ড চলছে। তাহলে আমরা কি স্বাধীনতা পেলাম। আমি যদি মাঠপর্যায়ে বর্বরতা দেখে মনে করি সত্য প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় তিন সাংবাদিককে হামলা করে ক্যামেরা ও মুঠোফোন ভাঙচুর করা হয়। ময়মনসিংহের ত্রিশালে চার সাংবাদিককে মারধর, লুটপাট ও অপমানের শিকার হতে হয়; এমনকি সাংবাদিক মতিউর রহমানের পা পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়। এছাড়া সাংবাদিক মনির বিশ্বাস কে পুলিশ রাজধানীর টেকনিকালে সামান্য বিষয় নিয়ে বেধড়ক মারপিট করে পা ভেঙ্গে দেয়। এ ধরনের হামলা কেবল ব্যক্তিকে নয়—রাজনৈতিক অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা পুরো সাংবাদিকতাকে পঙ্গু করার প্রচেষ্টা। স্বাধীন সংবাদকর্মীহীন সমাজ দ্রুত মিথ্যা তথ্য, গুজব ও স্বৈরাচারের দিকে ধাবিত হয়—এটাই বিশ্ব ইতিহাসের শিক্ষা। তাই বর্তমান সরকারের উচিত স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্ত ভুয়া মামলা ও হয়রানি করে সাংবাদিকতা কি থমকে যাবে? অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে অসংখ্য সাংবাদিককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত মামলায় জড়ানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই থানায় ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক মামলা দেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের ওপর এমন চাপ—নিরাপত্তাহীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিচ্ছে, যা সংবাদমাধ্যমকে খণ্ডিত, দুর্বল ও ভীত সন্ত্রস্ত করে দিচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে নিউজ করলে সাংবাদিকতে ধরে নিয়ে ছাত্রলীগ বানিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে এটা অনেক দুঃখ জনক। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত কিন্ত সরকারের সাংবাদিকদের বিষয়ে করণীয় স্পষ্ট এখনো করেনি। তাহলে নির্বাচন তথ্য সংগ্রহে সাংবাদিদের ভূমিকা কেমন হবে। এই নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে হলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো বিষয় নয়। কারণ—জনগণ তথ্য জানতে চায় সাংবাদিকদের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সহিংসতা বা অনিয়ম উন্মোচন করেন সাংবাদিকরাই। বিশ্ব সম্প্রদায়ও দেশের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়ন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ভিত্তিতে। আমি মনে করি এ অবস্থায় সরকারের উচিত— সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল ভুয়া মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা। হামলার ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মাঠে কাজ করা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।পুলিশ প্রমান ছাড়া যেন কেনা মামলা করতে না পারে। সাংবাদিকদের বিষয়ে মামলা করতে হলে অবশ্যই নিরেপেক্ষ দতন্ত করে করতে হবে। সাংবাদিকদের দমন করে কোনো সরকারই দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা পায়নি। বরং তথ্যচক্র বন্ধ করে দিলে সমাজ আরও অস্থির, অবিশ্বাসী এবং সহিংস হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সাংবাদিকরা রাষ্ট্রের শত্রু নন; তাঁরা রাষ্ট্রের আয়না। এই আয়না ভেঙে গেলে রাষ্ট্র অন্ধ হয়ে পড়ে। শিহাবউদ্দীন ও নিজামউদ্দীনের মতো নিরপরাধ সাংবাদিকদের কারাবন্দি রাখা, হামলা–নিপীড়ন অব্যাহত রাখা—এ সবই গণতন্ত্রের ভবিষ্যতকে গভীর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রেস ক্লাবের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক ও পাকিস্তান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মীর ইশতিয়াক আলী বলেন,অতি দ্রুত বাংলাদেশে স্বাধীন সংবাদিকতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
তিনি এ সময় সাংবাদিক শিহাবউদ্দীন ও নিজামউদ্দীনের মুক্তির দাবী করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউজ ক্লাবের চেয়ারম্যান ইজ্ঞিঃ মোঃ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, অতিদ্রুত সাংবাদিক শিহাব কে মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে কঠিন আন্দোলন করা হবে। আর কেন কোন অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে অতিদ্রুত তার প্রমান জাতির সামনে আনার দাবী জানান। এ বিষয়ে দক্ষিণ অঞ্চল সাংবাদিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া বলেন, দেশের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিন্ত করতে হবে। এবং গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে হবে।
]সাংবাদিক সমাজের রাষ্ট্রের প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের কাছে জোর দাবি—সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। সকল ভুয়া মামলা প্রত্যাহার করুন। শিহাবউদ্দীন ও নিজামউদ্দীনের নিঃশর্ত মুক্তি দিন। সত্যকে বন্দী করা যায় না—কিন্তু সত্য দমন করলে রাষ্ট্র নিজেই বন্দী হয়ে পড়ে।
লেখক ও গবেষক:
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতি, ঢাকা প্রেস ক্লাব ও
আন্তর্জাতিক প্রেস ক্লাব
Leave a Reply